Wednesday, May 30, 2018

গীতিনাট্যঃ দু'টি পিস্তল ।। আখতার উজ্জামান সুমন


আবহাওয়াটা উচ্ছ্বাস আর উল্লাসে ভরা। গ্যালারিতে দর্শকশ্রোতা মুহুর্মুহু করতালি আর চিৎকার দিয়ে অভিনন্দন জানাচ্ছে প্রিয় দলকে। প্রিয় খেলোয়াড় একের পর এক গোল দিয়ে যাচ্ছে প্রতিপক্ষের জালে। আজ ফাইনাল। বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসিত ঢেউ! হঠাৎ দৃশ্যপট পালটে গেলো।

চারপাশে অভিমানের ঢেউ। অভিমানী প্রশ্ন তুমি থেকে আপনিতে উঠে এসে জিজ্ঞেস করলো-
- ঘুমাননি এখনো?
বিগলিত উত্তর- না। অনুযোগ করে বলল- তুমিও তো ঘুমাওনি। বলতে বলতেই তার মনে হল, অভিমান কি প্রশ্নের একান্ত? তার প্রশ্নেও অভিমান থাকতে পারে! হ্যাঁ, থাকতেই হবে। তাই তার প্রশ্নও তুমি থেকে আপনিতে উঠে জিজ্ঞেস করলো-
- আপনি ঘুমাননি কেন?

ব্যাকগ্রাউন্ডে অলক্ষ্যে তখন আ............... ধ্বনিত হয়ে রোমাঞ্চ বেজে উঠলো। অলক্ষ্যে পর্দার আড়ালে গাইতে লাগলো-
"অনেক ভালোবাসি তোমাকে প্রিয়তম।
কসম চাও তো, নিতে পারো; খোদা কসম!
অনেক ভালোবাসি তোমাকে প্রিয়তম।
সাগরের বাহুডোরে উদারতা আছে যতো
আমারো প্রেম আছে তোমার তরে ততো।
এই যে অস্থিরতা, তা আর কখনো কমবে না।
আমার এই গান তোমারই ধ্যানজ্ঞান;
তোমাকে ছাড়া আর কোনো বাঁচা নেই আমার।
এভাবেই চাইতে থাকবো তোমায় যতক্ষণ আছে প্রাণ।
অনেক ভালোবাসি তোমাকে প্রিয়তম।
কসম চাও তো, নিতে পারো; খোদা কসম!"

গাওয়া শেষ। আ............... ধ্বনি এখনো চলছে অলক্ষ্যে। ভণিত অভিমান কমেনি এখনো। তবুও বলছে-
- হ্যাঁ, অনেক ভালোবাসি তোমাকে প্রিয়তম। কী করছেন?
দৃশ্যপটে চারদিক থেকে চোখ ধাঁধানো রক্তাক্ত হৃদয়গুলো উড়তে লাগলো। মুহূর্তের মধ্যে পেছনে হাজারো নক্ষত্র জ্বলে উঠেছে; কানে ঝনঝনানি দিয়ে ব্যাকগ্রাউন্ডে গাইতে শুরু হল-
"বকুলের মালা শুকাবে
রেখে দেব তার সুরভী
দিন গিয়ে রাতে লুকাবে
মুছো নাকো আমারই ছবি
আমি মিনতি করে গেলাম।
ভালোবেসে আমি বার বার
তোমারি ওমনে হারাবো
এই জীবনে আমি যে তোমার
মরণেও তোমারই হব।
তুমি ভুলো না আমারও নাম।
এই মন তোমাকে দিলাম
এই প্রেম তোমাকে দিলাম।
তুমি চোখের আড়াল হও
কাছে কিবা দূরে রও
মনে রেখো আমিও ছিলাম।"

এবার শাণিত ও ভণিত দু'টো অভিমানেরই অন্তর্ধান ঘটলো। বলল-
- ভালোবাসি।
- আলিঙ্গন করো।
- সেই কখন থেকেই করে আছি। টের পাওনি বোধ হয়।
আলতো করে ভিড়ানো দরজার আড়াল দিয়ে বাহির থেকে রক্তাক্ত হৃদয়গুলো ভিতরে প্রবেশ করতে লাগলো।
- সারাক্ষণ তোমার আলোকচিত্র দেখছিলাম।
- ভালোবাসি তোমায়।
- ভালোবাসি আমিও।
উভয়ে প্রেমালিঙ্গনে। চারপাশ থেকে রক্তাক্ত হৃদয়গুলো ফানুশের মতো বাতাসে উড়ে যাচ্ছে উপরের দিকে।
- ঘুমাবে না? এবার ঘুমাও।
- ঘুম আসে না।
ব্যাকগ্রাউন্ডে পিয়ানোর টুংটাং শব্দের সাথে গাওয়া শুরু হল-
"প্রাণের চেয়েও প্রিয় আমার হৃদয়
তাকে ছাড়া এক মুহূর্তও বাঁচা মুশকিল।
ওহ! ওহ! এ যে কী ব্যথা! ব্যথাটাও অনেক ব্যথানাশক। কখনো আমাকে হাসায়, কখনো কাঁদায়।
কেউ যাও, খুঁজে দাও;
কোথায় যেন আমার হৃদয় হারিয়ে গেল।
আমার ঘুম আসে না, আমার স্বস্তি আসে না;
কোথায় যেন আমার হৃদয় হারিয়ে গেল।"

এবার শাণিতের কিছুটা ভণিত অভিমান। বলল-
- তুমি ঘুমাতে পারো।
টুংটাং পিয়ানোর সাথে আবারো গাইতে শুরু হল-
"আমার ঘুম আসে না একেলা। তবে স্বপ্নে আসাযাওয়া করতে থাকো।
চলতে পারবো না তোমাকে ছাড়া আমি
তুমি আমার ভরসা হয়ে যাও
তোমাকে চাওয়া ব্যতীত আর কিছুই হবে না আমার দ্বারা
বলে দাওনা কী আছে তোমার হৃদয়ে
আমি কাউকেই বলবো না।"

টুংটাং করে পিয়ানোটা আরো কিছুক্ষণ বেজে চলল। বলল-
- হৃদয় কোথাও হারিয়ে যায়নি। খুঁজে দেখো, হৃদয়ের ভিতরেই হৃদয় আছে। কিছুই তো অবিদিত নেই, যা বলার সবই তো বলে দিয়েছি।

চারপাশে আবারো রক্তাক্ত হৃদয়, ফানুশের মতো উড়ে যাচ্ছে। ভায়োলিন বেজে উঠলো। এ এক করুণ সুর! এই সুর দৃশ্যপটে মহামারী ডেকে নিয়ে আসলো। চারপাশে হৃদয়-ফানুশগুলো আরো বেড়ে গেল। হঠাৎ একটা আবেগ এসে চারপাশটা নীলচে করে দিল।
- আজ তোমার কী হয়েছে প্রাণনাথ? এতো দুর্বলতা প্রকাশ করছো! প্রতিটা রাত আমি আবেগপ্রবণ হয়ে কতো কী কল্পনা করে, প্রত্যাশা করে দুর্বল হয়ে পড়ি। কতো কী জপতে জপতে রাতগুলো পার করি! আজ তুমিও.............
কথাটা শেষ হলো না, কথাটা মুখে থাকতেই ব্যাকগ্রান্ডে অলক্ষ্যে গীটারের মোটা তার বাজতে লাগলো, আর গাইতে শুরু হলো-
"কী করে যে বলি
তোমাকে ছাড়া এ জীবন যে কেমন হবে!
মনে হয় যেন কোনো শাস্তি, কোনো অভিশাপ হবে।
করেছি এই প্রতিজ্ঞা,
এ বাঁচা নয় তোমাকে ছাড়া।
বাঁচবো, হ্যাঁ বাঁচবো; তো তোমাকে ছাড়া কীভাবে?"

- আমাকে ছাড়া বাঁচার দরকার নেই। আমাকে নিয়েই বাঁচো। আমিও............
- বাঁচবো না, মরবো।
চারপাশ বেদনাহত। গাঢ় নীলাভ ধুয়া হয়ে ছেয়ে গেল। ভায়োলিন বাজছিল করুণ কান্নার সুরে। আচমকা চারপাশে হাজারো প্রদীপ জ্বলে গেলো। দু'জন দু'জনার খুঁট থেকে মরণাস্ত্র বের করলো। তাক করলো একে অপরের নাভিদেশের নিচে বামপাশে। তারা প্রস্তুত, গভীর আলিঙ্গনে তারা। একের পর এক দু'টি শব্দ হল আকাশ ফাটিয়ে। তারপর ভূতল ভেদ করে, মুহুর্মুহু শব্দ করে, আকাশে বাতাসে উঠতে থাকলো ধূমকেতু। একেকটি বিস্ফোটের শব্দাংশ বাকি থাকতেই আরেকটি বিস্ফোট, তারপর আরেকটি, তারপর আরেকটি। এভাবে চলতে থাকলো। ধূমকেতুগুলো মিলিয়ে যেতে থাকলো নিঃসীম আকাশে।
রক্তাক্ত ভূমিতল,
রক্তের উপর ভাসছে দু'টি অসাড় দেহ,
ভাসছে দু'টি মরণাস্ত্র,
দু'টি পিস্তল।

গ্যালারির দর্শকশ্রোতা মুখ হাত চেপে বসে আছে। প্রিয় দলকে একটার পর একটা গোল হজম করতে দেখছে। আর, বাঁধভাঙা অশ্রুর নীরব বিসর্জন করছে। খেলা শেষ। গ্যালারিভর্তি দর্শকশ্রোতা এভাবে আমৃত্যু দেখে দু'টি পিস্তলের আজব খেলা।
কবি ও সংগঠক আখতার উজ্জামান সুমন

No comments:

Post a Comment