Thursday, May 31, 2018

ঈদে বাবা আসবে ।। জেসমিন রুমি

রাত আড়াই'টা বাজে, কারওয়ান বাজার৷ রাস্তার ধারে বশির দাড়িয়ে আছে৷ বশির একা নয়, বশিরের মতো আরো অনেকেই আছে৷ সবার হাতে ব্যাগ, বস্তা,  কাপড়ের পোটলা৷ উত্তরবঙ্গ থেকে প্রতিদিন কাঁচা তরকারির ট্রাক আসে, রাতে আবার ফিরে যায়। সেই ট্রাক এ বাড়ি ফিরে সল্প আয়ের মানুষ৷চল্লিশ টাকা, পঞ্চাশ টাকায় রংপুর দিনাজপুর পার্বতিপুর যাওয়া যায়। উত্তর বঙ্গের যে কোন জায়গায় যাওয়া যায়৷ স্বল্প আয়ের মানুষের পক্ষে ছয়'শ, সাত'শ টাকা ভাড়া দিয়ে বাসে ট্রেনে বাড়ি যাওয়া সম্ভব হয় না৷ এই সুবিধাটা অনেক বড় পাওয়া বশিরের মতো মানুষদের জন্য।
বশির মাসে দু'বার বাড়ি যায়, কুড়িগ্রাম৷
বউ আছে, তিন ছেলে আছে৷ সুলতান, রাজা, বাদশা৷ বশিরের ভাঙ্গা ফুটা চালের, বেড়ার ঘরে রাজা বাদশা। বশির বউ কে বলেছিল হুন বউ, আল্লাহ্ চাইলে কিনা পারে৷ দেহিস আমার পোলারা একদিন রাজা বাদশা হবারও পারে।
অভাবের সংসার৷ সুলতান স্কুলে যায়৷ ক্লাস ফাইভে পড়ে৷ ছোট দুইটা এখনো স্কুলে যায়না৷ বাড়িতে খরের চালের দুইটা ঘর, বাড়ি ভিটায় চারদিক দিয়ে সারাবছর বিভিন্ন রকম শাক সবজি আবাদ করে বশির, সংসারের খাওয়াটা চলে তাতে৷ফাঁকে ফাঁকে ঢাকায় চলে আসে, পাইকারদের তরিতরকারীর ডালা টানে রাতভর৷ একটা মেস বাড়িতে কয়েকজন মিলে থাকে, খালাদের রান্না খায়৷ দশ বারো দিনে কিছু টাকা জমলেই বাড়ি যায়৷ এভাবেই কাটছে বশিরের সংসার৷
রোজার মাস, শেষবার যখন বশির ঢাকা আসলো আমেনা বলে দিছে ঈদের সময় শার্ট প্যান্ট নিয়ে নিতে, পোলাগো ঈদের জামা প্যান্ট৷ আমেনা বশিরের বউ, নিজের কথা কোনদিন একবারও বলেনা ৷তারপর ও বশির তো বোঝে, আমেনার দুইটা মোটা শাড়ি কত দরকার৷ সুলতান কখন এক ফাঁকে  সবাইকে লুকিয়ে ছোট্ট একটা চিঠি লিখে বশিরের কাপড়ের ব্যাগে চুপ করে রেখে দিসে৷
সেই চিঠি বশির এখনো খুলে দেখেনি৷ না জানি সুলতান কি লেখছে।
ধীরে ধীরে মানুষের ভীর বাড়ছে, কাল ঈদ, সব জায়গায় ঘরমূখো মানুষের ভীর৷ একটুপরই ট্রাক ছাড়বে, উত্তরবঙ্গ মূখী৷
ঝির ঝির বৃষ্টি পরছে, তিরিশ চল্লিশ জন মানুষ৷ শংকিত হয়ে পরে৷ ভিজতে হবে সারা পথ, বৃষ্টি যদি না থামে৷
সংবাদ পত্রের গাড়িগুলাতেও এই ব্যাবস্থা আছে৷বাড়ি ফেরার৷ সংবাদপত্রের গাড়িতে  আরো বেশী ভাল হয়,আরামে যাওয়া যায়, কাভার্ড ভ্যান৷ মনে হয় ঘরের মধ্যেই শুয়ে আছি৷ রোদ বৃষ্টির  টেনশন থাকেনা৷ কিন্তু ভাড়া'টা বেশী৷ সত্তর আশি টাকা চায় ৷ অনেকেই যেতে চায়, ভাড়া শুনে ঘুরে আসতে মুখ খারাপ করে গাল দেয় শালা'র এসি কোচ পাইছে? সুযোগ বুঝে ভাড়া বেশী চাইতেছে।
গাড়ি ছেড়ে দেয়৷ ট্রাকের পিছনে চল্লিশজন মানুষ গাদাগাদি গায়ে গায়ে হেলান দিয়ে বসে আছে৷ বেশীর ভাগ ওরা কুড়িগ্রাম রংপুর, গাইবান্ধার ....ঢাকায় অনেকেই বশিরের মতো এই পেশায় জড়িত,আর কয়েকজন রিক্সা চালায়৷ মাটি কাটে, রাজ মিস্ত্রির কাম করে ৷
সবার জন্যই নতুন কাপড় কিনছে বশির ,কারওয়ান বাজারে ঈদের সময় মনে হয় নতুন কাপড়ের হাট বসে ৷সবই পাওয়া যায় ৷পোলা গো, মাইয়া গো৷ আমেনার শাড়ী কিনছে, তিন বেটার শার্ট প্যান্ট ,বশিরের মাপ লাগেনা৷ চোখের আন্দাজে ঠিক মতোই কিনে৷ আহারে ! সুখে বুকটা ভরে যায় বশিরের৷
 ট্রাক ছাড়তেই ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসে বশিরের৷ সুলতানের চিঠির কথা মনে পরে৷ ব্যাগের মধ্যে হাত দিয়ে হাতড়িয়ে এক কোনায়  চিঠিটা পাওয়া যায় ৷
অল্প আলো আঁধারিতে চিঠিটা পড়ে বশির৷
সুলতানের হাতের লেখা তো বেশ সুন্দর হইছে !!
আব্বা,
এবার আসার সময় আমার জন্য শার্ট প্যান্ট আইনো ৷কেলাসের সব্বাই ঈদে নতুন শার্ট প্যান্ট কিনবে ৷ আমার সরম লাগবে আব্বা!
ভুলে যাইওনা৷ সুতা দিয়ে মাপ দিলাম৷
     ইতি
তোমার বড় ছেলে
সুলতান৷
 বশির চিঠিটা ভাজ করে পকেটে রাখে ,সুতাটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে ,মনে মনে বলে....কিনছি রে বাজান৷
       বশিরের চোখ লেগে আসে ,ঘুমিয়ে যায়৷ অন্য সবাই ঝিমাচ্ছে, ঘুমাচ্ছে৷ ট্রাক তখন যমুনা সেতু পার হয়ে ,সিরাজগঞ্জ মোড় পার হয়ে  হাটিকুমরুল থেকে বগুড়ার দিকে ছুটে চলছে৷ বৃষ্টির জোর বেড়েছে৷ মানুষ গুলা নীল পলিথিনের নীচে জোড়োসড়ো হয়ে ঘুমের মধ্যে ৷
বশির স্বপ্ন দেখে ঈদের জামা পরে বন্ধুদের লগে ঘুরছে, সুলতান যেন সত্যিকারের সুলতান ,চোখে মুখে একটুকুও সরম নাই ৷
সুলতান মেট্রিক পাশ দিলে ঢাকার গার্মেন্টেস এ একটা চাকরী হবে ,তখন বশির আর এতো কষ্টের কাম করবেনা ,ভেবে রাখছে৷ সেদিন আর কত দুর? কত দিন বাঁকী ......
        প্রচন্ড একটা ধাক্কায় বশিরের ঘুম ভাঙ্গে যায় ৷ সবাই জেগে গেছে ৷ ট্রাক চান্দাইকোনার কাছাকাছি প্রায় ৷ হৈচৈ ... হাউমাউ কান্নায় ভারি চারদিক৷ একটা নাইট কোচ থাক্কা দিয়েছে পিছন থেকে৷ নিয়ন্ত্রন নাই৷ বৃষ্টির পানিতে রাস্তা পিছলা৷
         বশিরদের ট্রাকটা তিনটা পল্টি দিয়ে একেবারে রাস্তার পাশের পাগারে৷ তারপর সব শেষ৷
চারিদিকে আশপাশের গ্রামের ,পাড়ার সব মানুষ জড়ো হয়ে গেছে৷ কিছুক্ষন আগে ঈদের নামায শেষ করেছে মুসুল্লিরা৷ অস্ফুট আওয়াজ মুখে ৷ এত্ত গুলা তাজা প্রাণ !ইশরে ঈদের দিন, ঈদটাও কপালে নাই .....
পাগারের পানি লাল হয়ে আছে৷ মনে হয় যেন লাল পানির বৃষ্টি হয়েছে ৷
প্রশাসনের লোকজন জমায়ত হয় ৷ তাৎক্ষনিক সব ব্যাবস্থা নেয় ৷ লাশ গুলো সব বগুড়া থানায় নিয়ে যায় ৷আইনি প্রকিয়া শেষ করে যার যার বাড়ি পৌছানোর লাশ ব্যাবস্থা নেয়া হবে৷

কুঁড়িগ্রাম , বাঁশ পাড়া, ঘরে ঘরে ঈদের খুশী৷পোলাপানরা সব দৌড়াদৌড়ি করে খেলছে, আনন্দে মেতেছে৷ আমেনা সেমাই রান্না করছে৷ তিন ভাই খাইছে,আমেনা বশিরের জন্য অপেক্ষা করে ৷সুলতান গেছে পাশেই এক বন্ধুর বাড়ি৷ টেলিভিশন দেখতে৷ বন্ধু জিগায় ..,তোর নতুন শার্ট কই রে....... সুলতান বলে ,বাবা আনবে৷ টেলিভিশনে দেখাচ্ছে ঢাকা থেকে উত্তর বঙ্গ গামী একটি শ্রমিক ভর্তি ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পাশের খাদে পরে গেছে৷
সুলতান মন খারাপ করে চলে আসে ৷বাবা যে কখন আসবে ,নতুন শার্ট প্যান্ট পড়ে বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাবে৷বাড়ান্দায় বসে বাবার জন্য অপেক্ষা করে, বাবা আসবে..
সুলতানের কানে একটা আওয়াজ এলো, মনে হলো বাহিরে কারা যেন বলছে বশির .............সুলতান এক ঝটকায় উঠে দাড়ায় ......বাড়ি কাঁপিয়ে আকাশ কাঁপিয়ে চিল্লায় বলে উঠে মা .... .....বাবা বাড়ি আসছে ....
সুলতান বাড়ির বাহিরে এসে দাড়ায়, পাশে আমেনা রাজা বাদশা কে নিয়ে দাড়িয়ে ৷দুরে দেখা যায় একটা ভ্যান আসছে, অনেক মানুষ সাথে  হেটে আসছে ...সব কিছু অস্পস্ট......!!!
কবি ও সংগঠক জেসমিন রুমি  

No comments:

Post a Comment