Monday, June 4, 2018

একজন ভালো বক্তা হওয়ার কিছু কলা-কৌশল ।। সৈয়দ আসাদুজ্জামান সুহান


আমরা প্রতিদিন বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন ধরণের বক্তৃতা শুনে থাকি। এই যেমন ধরুনঃ অফিসে, স্কুলে, মাঠে-ঘাটে-রাস্তায়, রেডিও-টেলিভিশনে, বিভিন্ন ধরণের সভা-সেমিনারে। আমাদের অনেকের ধারণা হচ্ছে, যিনি যত বেশি শিক্ষিত, তিনি তত বেশী ভালো বক্তা হবেন। এই ধারণাটি সম্পূর্ণরূপে ভুল, যার একটি উদাহরণ দিচ্ছি। আমরা দেখতে পাই, দেশের কিছু রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ লক্ষ লক্ষ মানুষের সামনে অকপটে দূর্দান্ত বক্তব্য রাখছেন। তাদের বক্তব্য শুনে লক্ষ লক্ষ মানুষ উজ্জীবিত হচ্ছেন। তাদের মধ্যে কারো কারো শিক্ষাগত যোগ্যতা অতি অল্প কিন্তু উনারা বিশাল মাপের অতি জনপ্রিয় বক্তা। লক্ষ লক্ষ মানুষ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে উনাদের বক্তব্য দীর্ঘ সময় নিয়ে শুনেন। পৃথিবীতে এমন অসংখ্য ব্যক্তির নাম বলা যাবে, যাঁদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কম থাকা সত্ত্বেও উনারা অনেক জনপ্রিয় বক্তা ছিলেন। আবার এমনও অনেক ব্যক্তি ছিলেন, যাঁরা অতি উচ্চ শিক্ষিত কিন্তু ভালো বক্তৃতা দিতে না পারার কারণে অন্য কেউ উনাদের লিখিত প্রবন্ধ পাঠ করতেন। আমরা কিছু কিছু বক্তার খুব সাধারণ কথা শুনলেও মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দীর্ঘ সময় ধরে উনাদের বক্তব্য শুনে যাই। আবার কিছু কিছু বক্তা অতি জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য প্রদানের করলেও অল্প সময় পরেই আমরা বক্তৃতা শুনতে বিরক্ত বোধ করি। আমরা সহজেই বুঝতে পারি, কে ভালো বক্তা কিন্তু তিনি কেন ভালো বক্তা, সেটা অনেকেই জানি না।

কেউ কেউ আছেন, বক্তৃতা দিতে গেলে হার্টবিট বেড়ে যায়। কারো কারো আবার হাত পা কাঁপে, গলা শুকিয়ে যায়। কেউ কেউ আছেন, অতিরিক্ত নার্ভাস হয়ে, যা বলতে এসেছিলেন, সেটাই ভুলে যান। এমনও কেউ আছেন, বেশি মানুষের সমাগম দেখলে কিংবা অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের সামনে বক্তৃতা প্রদান কালে অতিরিক্ত মানসিক চাপে ভুগেন। উনারা তখন বক্তব্যটা তালগোল পাকিয়ে জগাখিচুড়ি বানিয়ে ফেলেন। আমাদের অনেকের মাঝে এই সমস্যা গুলো আছে, যে কারণে আমরা ভালো বক্তা হতে পারি না। ভালো বক্তা হওয়ার কিছু কলা-কৌশল আছে। এই কলা কৌশল গুলো রপ্ত করতে পারলে একজন ভালো বক্তা হওয়া যায়।

☞ মনের ভয়টাকে জয় করাঃ
একজন বক্তা হওয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি জরুরি হচ্ছে নিজের মনের ভয়টাকে জয় করা। নিজের মনের ভেতরে ভয় নিয়ে কখনও বক্তা হওয়া যাবে না। মনের ভয়টাকে জয় করার সবচেয়ে সহজ কৌশল হচ্ছে, মানুষের সাথে চলাফেরা করা ও খোলা মনে কথা বলা। মনের ভেতরের জড়তা, সংকোচ পরিহার করে সবার সাথে নিয়মিত কথাবার্তা বলা। অন্যের সাথে কথা বলার সময় নিজের উপরে আত্ম বিশ্বাস রাখতে হবে। সর্বোপরি, অন্য কারো সাথে কথা বলার সময় ভাবতে হবে, তিনি আমার মতোই একজন মানুষ ভিন্ন অন্য কিছু নন। তবে হ্যাঁ, যিনি যতটুকু সম্মান পাওয়ার যোগ্য, উনাকে  সেই সম্মান অবশ্যই প্রদর্শন করতে হবে।

☞ অনুশীলনঃ
একজন ভালো বক্তা হওয়ার জন্য আমাদের অবশ্যই সর্বপ্রথম অনুশীলন করতে হবে। সবচেয়ে ভালো অনুশীলন করার জায়গা হচ্ছে আয়না। আমরা যদি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিয়মিত ভাবে বক্তৃতা প্রদান করি, তাহলে আমাদের জড়তা কাটিয়ে উঠতে সহায়তা হবে। এবং মুখের বাচন ভঙ্গি ও শারীরিক অঙ্গ ভঙ্গিতে দৃষ্টিকটু কিছু মনে হলে, সেটা সংশোধন করে নেওয়া যাবে। তারপর সাহস বৃদ্ধির জন্য মাঝেমধ্যে কৌশলে কাছের কিছু বন্ধুদের সামনে বক্তৃতা দেওয়ার মতো করে কথা বলে যাওয়া। এছাড়াও বিভিন্ন বক্তার বক্তৃতা মনোযোগ দিয়ে শোনা। কে কিভাবে বক্তব্য দিচ্ছেন, মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করা। সেই ভাবে নিজেকে তৈরি করে নেওয়া। এভাবে অনুশীলন করে এক সময় সভা-সেমিনারের একজন বক্তা হওয়া যাবে কিন্তু ভালো বক্তৃতা হওয়ার জন্য আরও অনেক কৌশল অবলম্বন করতে হবে।

☞ বক্তব্য প্রদানের প্রস্তুতিঃ
বক্তব্য প্রদানের পূর্বে কিছু প্রস্তুতি নেওয়া যেতে পারে, যা বক্তব্য প্রদানের সময় খুব সহায়ক ভূমিকা পালন করে। বক্তব্য প্রদানের পূর্বে আলোচ্য বিষয়টি জেনে নিয়ে তার উপরে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বুলেট পয়েন্ট লিখে নিয়ে যাওয়া যেতে পাবে। বক্তৃতা প্রদান কালে যা দেখে দেখে বক্তব্য প্রদান করলে অনায়াসে নির্ভূল বক্তব্য প্রদান করা যায়। অনেকেই আছেন খুব সাধারণ কিছু বিষয়ে ভুল করেন। যেমন বক্তৃতা প্রদান কালে আলোচ্য বিষয়টি বলতে গিয়ে ভুল করেন। ব্যক্তির নাম, পদবী কিংবা প্রতিষ্ঠানের নাম বলতে গিয়ে ভুল করেন। এছাড়াও আরও অনেক অনেক ভুল তথ্য প্রদান করে বক্তব্য দিয়ে যান। বক্তৃতা প্রদান কালে ভুল তথ্য দিলে মানুষের কাছে হাসির খোরাকে পরিণত হতে হয়। তাই বক্তব্য প্রদান কালে কোন ভাবে ভুল তথ্য প্রদান করা যাবে না। এই বিষয়টি খুব বেশি খেয়াল রাখতে হবে।

☞  শ্রুতাদের উপরে সমান দৃষ্টিপাতঃ
অনেকেই আছেন, বক্তৃতা প্রদান কালে শ্রুতাদের দিকে দৃষ্টিপাত করেন না। কেউ কেউ উপরের দিকে, কেউ কেউ নিচের দিকে, আবার নির্দিষ্ট কিছু মানুষের দিকে তাকিয়ে বক্তব্য রাখেন। এতে করে শ্রুতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায় না। বক্তৃতা প্রদান কালে শ্রুতাদের দিকে সমান দৃষ্টিপাত করতে হবে। নির্দিষ্ট কারো সাথে নয়, উপস্থিত সবার উপরে দৃষ্টি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সমান দৃষ্টিপাত করতে হবে। এতে করে খুব সহজেই শ্রুতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়। তখন শ্রুতারা ভিন্ন দিকে মনোযোগী হওয়ার সুযোগ পায় না এবং মনোযোগ দিয়ে বক্তব্য শুনে।

☞ বাচন ভঙ্গি ও অঙ্গ ভঙ্গিঃ
অনেকেই আছেন, যাদের বাচন ভঙ্গি ও শারীরিক অঙ্গ ভঙ্গি সুন্দর না হওয়ায় শ্রুতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হোন। কেউ কেউ আবার বক্তৃতা বক্তৃতা প্রদান কালে বাচন ভঙ্গি ও শারীরিক অঙ্গ ভঙ্গির কারণে শ্রুতাদের হাসির খোরাকে পরিণত হোন। বক্তৃতা প্রদান কালে বাচন ভঙ্গি ও শারীরিক অঙ্গ ভঙ্গি খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বক্তৃতা কখনও একি রকম স্বরে দেওয়া যাবে না। আবার খুব উচ্চ স্বরেও বক্তৃতা দেওয়া যাবে না, তেমনি খুব নিচু স্বরেও বক্তৃতা দেওয়া যাবে না। বক্তৃতা দেওয়ার সময় বক্তব্যের ধরণ অনুযায়ী স্বরের উঠা নামা করাতে হবে।  বক্তৃতা প্রদান কালে হাসির কথায় স্বর কোমল ও মুখে হাসি ফোটাতে হবে। কষ্টের কথায় স্বরে ব্যথিত ও চেহারায় কষ্ট ফোটাতে হবে। খুব শক্ত ও কঠিন কথায় স্বর বলিষ্ঠ ও চেহারা রূঢ় করতে হবে। মোট কথা, বক্তৃতার মাঝে একটি স্বরে ও চেহারার ভঙ্গিতে রিদম থাকতে হবে, যা শ্রুতাদের মুগ্ধ করে রাখবে। পাশাপাশি শারীরিক অঙ্গ ভঙ্গি বক্তব্যের ধরণ অনুযায়ী সুন্দর ভাবে সক্রিয় রাখতে হবে। বাচন ভঙ্গি ও শারীরিক অঙ্গ ভঙ্গি শ্রুতাদের সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে। তাই বক্তৃতা প্রদান কালে এই বিষয়ে খুব বেশি গুরুত্ব আরোপ করতে হবে।

☞ প্রাসঙ্গিক আলোচনাঃ
অনেকেই আছেন, বক্তৃতা প্রদান কালে প্রাসঙ্গিক বিষয়ের বাহিরে অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ে নিয়ে বেশি কথা বলেন। এতেও শ্রুতাদের মনোযোগ নষ্ট হয়ে যায় এবং এটি শ্রুতাদের বিরক্তির অন্যতম কারণ। যে প্রসঙ্গে আলোচনা হবে, সেই প্রসঙ্গের বাহিরে না যাওয়াই উত্তম। সব সময় চেষ্টা করতে হবে প্রাসঙ্গিক বিষয়ের উপরে বক্তব্য প্রদান করা। যদি প্রাসঙ্গিক বিষয়ে ভালো ধারণা না থাকলে, বক্তৃতা দীর্ঘ না করে সংক্ষিপ্ত করে নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ। সবচেয়ে বেশি ভালো হয়, অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ে কথা না বলে, পূর্বের বক্তব্যদের বক্তব্য থেকে কিছু অংশ আলোচনা করা।

☞ শ্রুতাদের ধরণ ও মনোভাব বিবেচনা করাঃ
বক্তৃতা প্রদান কালে সবার আগে খেয়াল রাখতে হবে, শ্রুতারা কোন ধরণের মানুষ। অনেক সময় দেখা যায়, শ্রুতাদের অধিকাংশ উচ্চ শিক্ষিত আবার কখনও দেখা যায়, অধিকাংশ শ্রুতাই কম শিক্ষিত বা অশিক্ষিত। উচ্চ শিক্ষিত শ্রুতাদের সামনে যেভাবে বক্তব্য প্রদান খুব বেশি মনোযোগ আকর্ষণ করা যায়। অনুরূপ বক্তব্য কম শিক্ষিত বা অশিক্ষিত মানুষের কাছে মনোযোগ আকর্ষণ করতে পুরোপুরি ভাবে ব্যর্থ হয়। শ্রুতাদের ধরণ অনুযায়ী বক্তব্য প্রদান করলে, সেই বক্তৃতা শ্রুতাদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়। এছাড়াও শ্রুতাদের মনোভাব বুঝতে হবে এবং সেই মনোভাব অনুযায়ী বক্তব্য প্রদান করতে হবে। যেমন, অতি ধার্মিক মনোভাবের শ্রুতাদের কাছে যেমন প্রগতিশীল চেতনার বক্তব্য আবেদন রাখতে পারে না, তেমনি প্রগতিশীল মনোভাবের শ্রুতাদের কাছে ধার্মিক মনোভাব থেকে বক্তব্য প্রদান করলেও সেটা আবেদন রাখতে ব্যর্থ হয়। তেমনি ভাবেই, ছাত্রদের কাছে যে বক্তব্য খুব আকর্ষণীয় কিন্তু একই বক্তৃতা বয়োঃজ্যেষ্ঠদের কাছে পুরোপুরি ভাবেই ব্যর্থ। এভাবেই, বিভিন্ন বয়স, শ্রেণী ও মতাদর্শের কারণে ভিন্ন ভিন্ন মনোভাবের শ্রুতা থাকে এবং তাদের মনোভাব বুঝে বক্তৃতা দিতে পারলেই খুব সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়।

☞ শ্রুতাদের মনের অব্যক্ত কথাগুলা বলাঃ
অনেক বক্তব্য আছেন, শ্রুতারা আসলে কি শুনতে চাচ্ছেন, সেটাই ধরতে পারেন না। তাই খুব সুন্দর ভাবে বক্তব্য প্রদানের পরেও শ্রুতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়। শ্রুতাদের মনের অব্যক্ত কথাগুলা অনুধাবন করতে হবে এবং সেই কথাগুলো বলতে বলতে পারলেই খুব সহজেই শ্রুতাদের খুব সহজেই মনোযোগ আকর্ষণ করা যায়। শ্রুতাদের তখন মনে হয়, তার মনের অব্যক্ত কথাগুলা বক্তা তার বক্তৃতায় বলছেন। শ্রুতারা সব সময় প্রত্যাশা করে, তাদের মনের অব্যক্ত কথাগুলা বক্তারা বলুক। তাই এই বিষয়ে খুব বেশি গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। যিনি এই বিষয়ে খুব পারদর্শী, তিনি শ্রুতাদের কাছে প্রিয় ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেন।

যাঁরা আমাদের দৃষ্টিতে ভালো বক্তা, আমরা দেখতে পাবো, তাদের বক্তব্যের মাঝে উপরের কলা কৌশল গুলো বিদ্যমান। তাই উপরের কলা-কৌশল গুলো রপ্ত করতে পারলে, আমরা একজন ভালো বক্তা হতে পারবো। তবে হ্যাঁ, পরিশেষে একটি কথা বলতে হবে, যিনি যত ভালো শ্রুতা হবেন, তিনি তত ভালো বক্তা হতে পারবেন।

লেখকঃ সৈয়দ আসাদুজ্জামান সুহান
সম্পাদক, ত্রৈমাসিক আমাদের গল্পকথা।
ঢাকা, বাংলাদেশ।

No comments:

Post a Comment